সেমিনার

রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা

সেমিনারপত্র প্রণয়নে:
আবদুস ছাত্তার খান ও মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন
তারিখ: ২১ সেপ্টম্বর, ২০২৪ 
স্থান: মাইক্রোবায়োলজি অডিটরিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সভাপতি: আবদুস ছাত্তার খান
প্রধান অতিথি:
জনাব বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, উপদেষ্টা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়,
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
বিশেষ অতিথি:
জনাব আফসানা বেগম, পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র
জনাব সফিক ইসলাম, শিক্ষক ও লেখক
জনাব ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও প্রকাশক

সেমিনারপত্র (পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করুন)

রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা

১. পটভূমি:

“রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনারের সম্মানীত সভাপতি, প্রধান অতিথি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, বিশেষ অতিথি জনাব আফসানা বেগম, পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, জনাব সফিক ইসলাম, শিক্ষক ও লেখক, জনাব ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও প্রকাশক। সেমিনারে আগত আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের সহযোদ্ধা ভাই ও বোনেরা।

আজকের মূল প্রবন্ধে থাকছে- সভ্যতার বিকাশে পাঠাগারের ভূমিকা, সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ, বাংলাদেশে পাঠাগারসমূহের বিদ্যমান সমস্যাসমূহ, পাঠাগারসমূহের সম্ভাবনা ও রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগার আন্দোলন, পাঠাগার বিষয়ক নীতি ও কৌশল এবং সবশেষে কিছু প্রস্তাবনা।

২. সভ্যতার বিকাশে পাঠাগারের ভূমিকা:

পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশে পাঠাগারগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। পাঠাগার শুধু জ্ঞান ও তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করেনি, বরং সভ্যতার অগ্রগতি ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর ও গ্রিসের পাঠাগারগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এসব পাঠাগারে সংরক্ষিত জ্ঞান সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত পাঠাগার প্রাচীন বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ছিল। এখানে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা হত এবং সেই জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হত। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞান, এবং শিল্পকলার উন্নয়নে ভূমিকা রাখত। ভারতের নালন্দা পাঠাগারের কথা তো সর্বজন বিদিত।

মধ্যযুগেও পাঠাগারগুলো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন মঠ ও মসজিদে স্থাপিত পাঠাগারগুলোতে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ও দর্শনের চর্চা হত। ইসলামিক সভ্যতার স্বর্ণযুগে বাগদাদের বায়তুল হিকমা (জ্ঞান ঘর) জ্ঞান ও গবেষণার এক মহাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করেছিল।

আধুনিক যুগে পাঠাগারগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তির বিকাশ, এবং মানবিক চিন্তার অগ্রগতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। গণপাঠাগার আন্দোলন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে জ্ঞান পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ২১শ শতকের ডিজিটাল যুগেও ই-বুক ও অনলাইন পাঠাগারগুলো বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের প্রসার ও বিনিময়ের মাধ্যমে সভ্যতার উন্নয়নে অবদান রাখছে।

সর্বোপরি, পাঠাগারগুলো সভ্যতার জ্ঞানের আধার হিসেবে বিভিন্ন সময়ের বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক, এবং সামাজিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মোট কথা যে কোন সভ্যতার বিকাশে ঐ সময়ের কোন না কোন পাঠাগার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে থাকে।

৩. বাংলাদেশে পাঠাগার আন্দোলন ও সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ: 

১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে গ্রন্থাগার আইন প্রণীত হয়। তার ঢেউ এসে এই বাংলাদেশেও লাগে। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে যশোরে পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল, রংপুর ও বগুড়ায় এবং ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি গ্রন্থাগারকে সহায়তা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু এর কোন নীতিমালা ছিল না। একই ধারায় বাংলাদেশে আজ অবধি নতুন নতুন নীতির ভিত্তিতে সরকারি সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

জ্ঞান-নির্ভর ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা মানুষের বহু দিনের। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের এ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সমাজের সর্বস্তরে চিন্তার একটি ঐক্যসূত্র অত্যাবশ্যক। জ্ঞান-নির্ভর, ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে “পাঠাগার হোক গণমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়” এ শ্লোগানকে সামনে রেখে সারা বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে যে পাঠাগারগুলো গড়ে উঠেছে সেই সমস্ত পাঠাগারের সংগঠকবৃন্দের সাথে পারস্পরিক ভাব বিনিময়, যোগাযোগ বৃদ্ধি, সাংগঠনিক নানা সমস্যা নিয়ে মতবিনিময়, সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরা এবং পাঠাগারগুলোর সাথে চিন্তার ঐক্যসূত্র গড়ে তোলা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ২০২২ সালে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার প্রত্যান্ত গ্রাম অর্জুনাতে তিনদিনব্যাপী  একটি আবাসিক পাঠাগার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলনে সারা দেশের ২৫০টি পাঠাগারের প্রায় ৫০০ প্রতিনিধি যোগ দেন।  পাঠাগার সমূহের বিদ্যমান সমস্যা নিরসনকল্পে , সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া তুলে ধরতে, পাঠাগারসমূহের মধ্যে আন্ত:যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে বেসরকারি পাঠাগারগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয়। এরই প্রেক্ষিতে সম্মেলনের তৃতীয় দিন ‘সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন’ নামে আমাদের এই প্রিয় সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়।

২৬ মার্চ ২০২৩ রবিবার সকাল ১০ টায় ঢাকায় সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন এর বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংগঠনটির ২১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১২ মে, ২০২৩ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নওগাঁর পতিসর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন কেন্দ্রীয় পরিষদের সাংগঠনিক কর্মশালা ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক “কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কর্মশালা”য় সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র অনুমোদন, সংগঠন ওয়েবসাইট পরিকল্পনার চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক বিশেষ কর্মশালাসহ বার্ষিক সাংগঠনিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়।

সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন কেন্দ্রীয় পরিষদের সাংগঠনিক কর্মশালায় “পতিসর ঘোষণা” দেশের পাঠাগার আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক ঐতিহাসিক ক্ষণের স্বাক্ষী।

পতিসর ঘোষণা:

১. দেশের সকল প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাসহ পর্যটন কেন্দ্রসমূহে সংশিষ্ট বিষয় ভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন করতে হবে।

২. জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রতি বছর পাঠাগারগুলোকে যে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করে তা বৃদ্ধি করে নূন্যতম ১৫০০০০ টাকা করতে হবে।

৩. জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক তালিকাভুক্ত সকল পাঠাগারকে এই অনুদানের আওতায় আনতে হবে।

৪. সকল সরকারী দপ্তরসমূহে পাঠাগার স্থাপন করতে হবে।

৫. দূরপাল্লার ট্রেন, বাস, লঞ্চে পাঠাগার স্থাপন করতে হবে।

৬. প্রত্যেক কোম্পানীর সিএসআর তহবিলের শতকরার ১০ভাগ পাঠাগার উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে।

সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন এর ২০২৩-২০২৫ সালের দ্বিবার্ষিক কর্মপরিকল্পনার ৩৮টি কর্মকান্ডকে পাঁচটি থিম এ বিভক্ত করা হয়। থিমগুলো হলো ১) স্মার্ট পাঠক- স্মার্ট নাগরিক ২) একটি গ্রাম একটি পাঠাগার ৩) স্মার্ট পাঠাগার নীতিমালা ৪) জ্ঞান ভিত্তিক অর্থনীতি এবং ৫) সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে সারা দেশে পাঠাগারের বিস্তার, মান উন্নয়ন ও পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে  বিভিন্ন পাঠাগারে মান সম্পন্ন বই উপহার, বর্ষপঞ্জিকা মুদ্রণ ও বিতরণ, পতিসর ঘোষণাসহ নানা কার্যক্রম করে আসছে। সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন প্রবাসী বন্ধুদের সংগঠন ‘একতারা ‘ এর সহযোগিতায় শিশু-কিশোরদের মনে মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ জাগিয়ে তোলার জন্য দেশ জুড়ে গড়ে উঠা এ যাবত ১২৭টি পাঠাগারের প্রতিটিতে পনেরটি করে মহাকাশ বিষয়ক বই উপহার দিয়েছে। এছাড়াও দেশে-বিদেশে অবস্থানরত পাঠাগার সুহৃদগণের ঐকান্তিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মননশীল বই উপহার দেওয়া হয়েছে। দেশের সুবিধাবঞ্চিত এলাকা যেমন- চা-বাগান, নিম্ন শিক্ষার হার, অসচেতন এলাকায় পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আয়োজন করা হয়েছে পাঠাগার বিষয়ক অনলাইন আলোচনা সভার।

৪. বাংলাদেশে পাঠাগারসমূহের বিদ্যমান সমস্যাসমূহ: 

বাংলাদেশের পাঠাগারসমূহ সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় ভূগছে তা হলো পাঠক সংকট। একদিকে যেমন প্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি হওয়ায় তরুণ সমাজ বই বিমূখ হয়ে পড়ছে। অপরদিকে আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাঠাগারের সেবার মানোন্নয়ন ও বৈচিত্রতা আনার ক্ষেত্রেও সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। পাঠককে আকৃষ্ট করার মতো তাদের রুচি এবং বয়স উপযোগী বই পাঠাগারগুলোতে নাই বললেই চলে। যেহেতু পাঠাগারগুলো স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত হয় এবং  অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকে ফলে তারা সাম্প্রতিক সময়ে সাড়া জাগানো বইগুলো সংগ্রহ করতে পারে না। এটাও পাঠক সংকটের অন্যতম কারণ। তারপর পাঠাগারগুলোর অবকাঠামোগত অবস্থা পাঠক বান্ধব নয়। নেই খোলা ও বন্ধ হওয়ার নির্দিষ্ট কোন সময়সূচি। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে পাঠাগার প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। সামাজিকভাবেও পাঠাগার সংগঠকদের হেয় করে দেখা হয় যা তাদের মধ্যে হীনমন্যতাবোধ তৈরি করে।

সরকারি অনুদান প্রকৃত পাঠাগার সংগঠকদের কাছে পৌঁছায় না। রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্তিত্বহীন ও অকার্যকর বিভিন্ন পাঠাগারকে অনুদান প্রদান করা হয়েছে। অনুদানের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল হওয়ায় অনেক যোগ্য পাঠাগারও হয়রানির আশংকায় আবেদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন না। সরকারি অর্থ ব্যয় করে গণমানুষের চাহিদার সাথে সংগতিহীন বই অনুদান হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, প্রতি বছর  সরকারি অনুদানের জন্য পাঠাগারগুলোর নিকট হতে আবেদন আহ্বান করা হয়। এই আবেদন করতে গিয়ে তৃণমূলের সংগঠকদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার সুপারিশের প্রয়োজন হয়। নানা কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে পাঠাগারের সংগঠকদের দূরত্ব তৈরি হতে পারে। আবার প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলীযোগ্য চাকরি হওয়ায় তাদের পক্ষেও সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিতে হয়। অনেক সময় তাদের বিভ্রান্তও করা হয়। ফলে দেখা যায় একশ্রেণির ভূতুড়ে পাঠাগার রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়  প্রশাসনকে ব্যবহার করে অনুদানের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। যা বিভিন্ন সময় জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।

৫. পাঠাগারসমূহের সম্ভাবনা ও রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগার আন্দোলন:

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে একটি ঐতিহাসিক মহুর্ত অতিক্রম করছে। সর্ব জায়গা থেকে আওয়াজ উঠছে রাষ্ট্রসংস্কারের। জ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন, মানবিক সমাজ বিনির্মাণে পাঠাগার রাখতে পারে অনবদ্য ভূমিকা। বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি-২০২৩ এর নীতি-৩.২ এ উল্লেখ আছে- “গণগ্রন্থাগার নেটওয়ার্ক ক্রমান্বয়ে গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারিত করা, যাতে যে কোন নাগরিক তাঁর বাসস্থানের দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি গণগ্রন্থাগার বা এর শাখা গ্রন্থাগার থেকে পরিষেবা পেতে পারেন।” অথচ বাংলোদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছরে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে মাত্র ৭১টি গ্রন্থাগার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে  ৯২৪টি বেসরকারি পাঠাগারে মাত্র ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার বই ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। অথচ দেশে অনুদান প্রত্যাশী বেসরকারি পাঠাগারের সংখ্যা ৩০০০ (তিন হাজার) এরও বেশি। তৃণমূলে গড়ে উঠা এই পাঠাগারগুলোর সংগঠকদের সাথে আলাপ আলোচনা করে সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন মনে করে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রনয়নের মাধ্যমে, পাঠাগারগুলোকে সম্মিলিতভাবে পরিচালিত করতে পারলে বাংলাদেশের দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি ও জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে এই পাঠাগারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লক্ষ্য করা গেছে, প্রায় শত বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাঠাগার গড়ে উঠছে। সেই পাঠাগারগুলো ঐ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠনে ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। উদ্যোক্তাদের পরিবর্তিত সামাজিক ব্যবস্থা এবং জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে হতে হয় স্থানচ্যুত। সঠিক নেতৃত্ব ও রক্ষণাবেক্ষেনের অভাবে এক সময় পাঠাগারগুলো হয়ে যায় বিলীন। পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে যায় নেতৃত্বহীন। সাংস্কৃতিক দিশা না থাকায় তরুণরা নেশাসহ নানান অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। তাই এই পাঠাগারগুলোকে জীবীত রাখার জন্য দরকার একজন সার্বক্ষণিক পেশাদার গ্রন্থাগারিক। যিনি নিয়ম করে পাঠাগার খুলবেন, বইয়ের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কর্মসূচী গ্রহণ করবেন এবং তার বাস্তবায়নে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিবেন। যেহেতু একটি পাঠাগার দুই বর্গকিমি এলাকা নিয়ে কাজ করবে। একেকজন গ্রন্থাগারিকের নেতৃত্বে কিছু স্বেচ্ছাসেবী তরুণদের নিয়ে তারা জরিপের মাধ্যমে চাহিদা নিরূপন করবেন। প্রকৃত তথ্য পাঠাগারের হাতে থাকেলে পাঠকের বয়স ও রুচী অনুযায়ী বই সংগ্রহ করা সহজতর হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠকের দোরগড়ায় পৌঁছনো যাবে পঠাগার পরিষেবা। এই তথ্যগুলো রাষ্ট্রও নানা কাজে ব্যবহার করতে পারবে। প্রাণ পাবে পাঠাগারগুলো। সমৃদ্ধশালী হবে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মান ও রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ। তাই দেশে চলমান রাষ্ট্র সংস্কারের মহতি উদ্যোগে সারথী হতে পারে সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন।

৬. পাঠাগার বিষয়ক নীতি ও প্রস্তাবনা:

পাঠাগার পরিচালনার জন্য অভিন্ন নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। যদিও বেসরকারি গ্রন্থাগারে অনুদান বরাদ্দ এবং বই নির্বাচন ও সরবরাহ সংক্রান্ত নীতিমালা রয়েছে এবং তা অনুসরণ করে প্রতি বছর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বিভিন্ন পাঠাগারকে বই অনুদান দিয়ে থাকে। তবে অনুদানের জন্য প্রতিবছর আবেদনের প্রথা তুলে দিয়ে বেসরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো পাঠাগারগুলোকেও এমপিও ভুক্তির আওতায় আনা যেতে পারে। নিবন্ধন ও অনুদানপ্রাপ্ত পাঠাগারগুলোকে নিয়মিত পরিবীক্ষণ এর জন্য জেলা শিক্ষা অফিস বা সমাজসেবা অফিস বা স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমি দায়িত্ব পালন করতে পারে। এতে পাঠাগারগুলো যেমন হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পাবে একই ভাবে সরকারও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে পাঠাগারের স্বকীয়তায় যাতে কোন হস্তক্ষেপ না করা হয়। তা না হলে পাঠাগারও একটি গতানুগতিক সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে লেখক, প্রকাশক, সরকারি প্রতিনিধি, পাঠাগার প্রতিনিধি, বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটি নির্বাচিত বইয়ের একটি তালিকা প্রস্তুত করবে যা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অনলাইন তথ্যভাণ্ডারে বা ওয়েব পোর্টালে আপলোড করা থাকবে। তথ্য ভাণ্ডারে বইগুলোকে বিভিন্ন প্রকরণে (যেমন- গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, জীবনী, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি) খোঁজা এবং নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে। অনুদানের জন্য নির্বাচিত পাঠাগারগুলো তাদের অনুদানের সমপরিমাণ বই বাছাই করতে পারবে। এতে যেমন পাঠাগারে বইয়ের বৈচিত্রতা আসবে। আবার পাঠাগারসমূহ তাদের প্রয়োজন মতো বই বাছাই করতে পারবে।

শুধু বই বা অনুদানের ক্ষেত্রে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ভূমিকা সামীবদ্ধ না রেখে জাতীয়ভাবে বইপড়া কর্মসূচী পরিচালনা করতে হবে। এর ভিতর দিয়ে সেরা পাঠক, সেরা পাঠাগার, সেরা সংগঠক নির্বাচন করতে পারে। পরে কেন্দ্রিয়ভাবে একটি অনুষ্ঠান করে জেলা, বিভাগ ও জাতীয়ভাবে সেরাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে তৃণমূল পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারে নতুনদের মধ্যে একটা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এই সেরা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বই পড়াটাকে একমাত্র মাপকাঠি না ধরে আরো অনেকগুলো মাপকাঠি যোগ করা যেতে পারে। যেমন স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে বৃক্ষ রোপন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা, সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে পাঠাগার সমৃদ্ধকরণ, রাষ্ট্র সংস্কারে জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পৃক্তকরণ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় ভূমিকা পালন ইত্যাদি বিষয় রাখা যেতে পারে। মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে পাঠাগারগুলোকে র‌্যাংকিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে আলোর ফেরি অ্যাপস এ ধরনের কাজ করে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা সুদৃঢ় ও সংঘবদ্ধ করতে দরকার প্রতি উপজেলায় একটি করে মডেল পাঠাগার। যেখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারের পাশাপাশি থাকেব একটি মিলনায়তন। স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়। সরকারের শিশু একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমীর শাখাও থাকতে পারে এই মডেল পাঠাগারে। সরকারি বেসরকারি নানা সংস্থার  সভা, সেমিনার সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হবে এই মডেল পাঠাগারকে কেন্দ্র করে। মোট কথা এই মডেল পাঠাগারই হবে একটি উপজেলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু।

রাষ্ট্রের কাছে পাঠাগার সুহৃদগণের দাবি প্রাথমিকভাবে নিবন্ধিত পাঠাগারসমূহে অতি স্বত্বর গ্রান্থাগারিক নিয়োগ দিয়ে পাঠাগারগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনা হোক। এবং একই কাঠামো অনুসরণ করে সুনির্দষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ২ কিলোমিটারের মধ্যে পাঠাগার স্থাপন ও পরিচালনা নিশ্চিত করা হোক।

সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনকে বেগবান করতে যেসকল বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করতে বদ্ধপরিকর সেব প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অধীনে নিবন্ধন লাভ, তাদের প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে সার্বিক সহযোগিতা করলে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ ত্বরান্বিত হবে।

আজ ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন এ মূল প্রবন্ধের ভিত্তিতে ঢাকা ঘোষণা প্রদান করতে যাচ্ছে। সেমিনার শেষে সংগঠনের সভাপতি জনাব আবদুস ছাত্তার খান ঘোষণাটি পাঠ করবেন।

উপস্থিত সুধী, আজকের সেমিনারে উপস্থিত থেকে মূল প্রবন্ধটি ধৈর্য্য ধরে শোনার জন্য আপনাদের সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশা করি উন্মুক্ত আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আপনাদের মূল্যবান মতামত দিয়ে সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনকে আরো বেগবান করবেন। এ মূল প্রবন্ধ পণয়নে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ওয়েব সাইট, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও পুস্তকের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। আমরা তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

[প্রণয়নে: 

আবদুস ছাত্তার খান, সভাপতি, সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন (ফোন: ০১৭৫২০২৩১৭৭, ই-মেইল: ‍satter317@gmail.com)

ও 

মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন, সহ-সভাপতি, সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন (ফোন: ০১৭১১৩১১১৭৩, ই-মেইল: ‍mosharrof@eshebee.com)

২১ সেপ্টম্বর, ২০২৪ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অডিটরিয়ামে সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন কর্তৃক আয়োজিত “রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগারের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন, সহসভাপতি, সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলন।]